গাছ কাটার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় কেন?
আসসালামু আলাইকুম bdvlog24 এর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম। আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হলঃ গাছ কাটার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় কেন? লিখছি আমি আমির হামজা, তো চলুন আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শুরু করা যাক।
বৃক্ষরাজির শ্বাসপ্রশ্বাসের গুরুত্ব
বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ-নির্গমনের মাধ্যমে বৃক্ষরাজি পৃথিবীর জীবনধারার ভারসাম্য রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তারা অক্সিজেন নিঃসরণ করে জীবজগতের বেঁচে থাকার মূল উপাদান সরবরাহ করে এবং বিষাক্ত কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ রাখতে সহায়তা করে। এছাড়াও অন্যান্য ক্ষতিকর গ্যাস যেমন কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও সালফার ডাই-অক্সাইডকেও গাছগাছালি শোষণ করে পরিবেশ শুদ্ধ রাখতে সহায়ক হয়।
বৃক্ষলতাদি শুধু গ্যাস বিনিময়ের মাধ্যমেই নয়, তারা শব্দদূষণও প্রতিরোধ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এক হেক্টর মাঝারি বনাঞ্চল ১০ ডেসিবেল শব্দ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এমনকি বৃক্ষচ্ছায়ায় কর্মক্ষেত্র থাকায় অতিরিক্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়, ফলে গ্রীষ্মকালীন উত্তাপ হ্রাস পায়।
বনভূমি সংকোচনের কারণসমূহ
বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের জন্য বনভূমি দ্রুত হারে ব্যবহৃত হচ্ছে। শহরায়ণ, কলকারখানা স্থাপন, সড়ক নির্মাণ, বসতি স্থাপন ইত্যাদি কারণে বনাঞ্চল পাইকারি হারে কমে যাচ্ছে। ফলে বহু প্রজাতির প্রাণী আবাসহীন হয়ে পড়ছে এবং ক্রমশই বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হচ্ছে।
বাংলাদেশের বর্তমান বনভূমির পরিমাণ মাত্র ২৫ লাখ ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর বা প্রায় ১৭.৮ শতাংশ, যা একটি দেশের জন্য স্বাভাবিক প্রয়োজনের (২৫ শতাংশ) তুলনায় অনেক কম। এমনকি এই কম পরিসরেও অবৈধভাবে বনভূমি অপচয় হচ্ছে। প্রভাবশালী মহল ও কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় বিভিন্ন বনাঞ্চলের গাছগাছালি নির্বিচারে কাটা হচ্ছে।
পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার পরিণতি
বনভূমি সংকোচন ও অবৈধ বৃক্ষনিধনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে আবহাওয়ার ওপর। বৃষ্টির সময়ে অনাবৃষ্টি এবং অসময়ে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তাপমাত্রার রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলশ্রুতিতে কোথাও খরা দেখা দিচ্ছে, আবার কোথাও বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গ্রীনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ বৃদ্ধি পাওয়ায় গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, যদি এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে মেরুপ্রান্তের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে এবং উপকূলীয় অনেক এলাকা জলমগ্ন হয়ে যেতে পারে।
বনাঞ্চল উজাড়ের ফলে বন্যপ্রাণীরা তাদের আবাসস্থল হারাচ্ছে। এতে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। অনেক প্রজাতির প্রাণী ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে রয়েছে।
বনভূমি সংরক্ষণের উপায়সমূহ
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে বনভূমি সংরক্ষণ করা অপরিহার্য। এজন্য সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। অবৈধ বৃক্ষনিধন রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত জরুরি।
- শহরাঞ্চলে রাস্তার দুপাশে গাছ লাগানো যেতে পারে
- বিদ্যমান বনাঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা বৃদ্ধি করতে হবে
- বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন
- স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বনায়ন কাজে সম্পৃক্ত করে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করা যেতে পারে
বনভূমি রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি সকল পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে। এতে করে পৃথিবীকে বাঁচানো যাবে।
আমাজন অরণ্যের অপরিসীম গুরুত্ব
বিশ্বের বৃহত্তম বনাঞ্চল হিসেবে আমাজন অরণ্য পৃথিবীর জন্য অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। এটি পৃথিবীর প্রায় ২০ শতাংশ অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে বলে একে 'পৃথিবীর ফুসফুস' বলা হয়। আমাজনে প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন বৃক্ষ রয়েছে, যা ১৬ হাজার প্রজাতিতে বিভক্ত। এই বিশাল বনাঞ্চলকে প্রকৃতি নিজেই গড়ে তুলেছে।
মানুষের অন্ধ আগ্রাসন ও অবৈধ বৃক্ষনিধনের কারণে আমাজন অরণ্যের অবস্থা ক্রমশই অবনতি হচ্ছে। বিশ্বের এই ফুসফুসের ধ্বংস ঘটলে তা পৃথিবীর জন্য মারাত্মক হবে। সুতরাং আমাজন অরণ্য রক্ষা করা মানবজাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বনভূমি সংরক্ষণ এবং বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ গ্রহণ
বনভূমি সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই বলেই সরকার প্রতিবছর বৃহৎ আকারে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হাতে নেয়। জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান, বনভূমি বৃদ্ধি ও বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের বনভূমি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও বনায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির পাশাপাশি, বিদ্যমান বনাঞ্চল সংরক্ষণেও নজর দেওয়া হচ্ছে। বনবিভাগের মাধ্যমে বনজ অপরাধ প্রতিরোধ ও বনাঞ্চল সুরক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন বন্যপ্রাণী আবাসভূমি এবং বনাঞ্চলকে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে জাতীয় উদ্যান ও আরক্ষিত বনাঞ্চলগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বনভূমি সংরক্ষণের সুফল
বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে দেশের বনভূমি সামান্য হলেও বৃদ্ধি পেয়েছে। বনভূমি বৃদ্ধির কারণে বায়ুর গুণগত মান উন্নত হওয়ায় শহুরে বসবাসকারী মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা কমেছে। এছাড়াও বনভূমি বৃদ্ধির কারণে বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল সুরক্ষিত হচ্ছে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষিত হচ্ছে।
তবে বনভূমি বৃদ্ধির হার এখনও সন্তোষজনক নয়। অবৈধ বৃক্ষনিধন ও বনাঞ্চল অপচয়ের কার বৈধ বৃক্ষনিধন ও বনাঞ্চল অপচয়ের কারণে বনভূমি সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই বনভূমি সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম আরও তৎপরতার সাথে বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সকল পক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য।
বনভূমি সংরক্ষণের বাধাবিঘ্ন ও চ্যালেঞ্জসমূহ
বনভূমি সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিভিন্ন বাধা-বিঘ্ন রয়েছে। প্রথমত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বসতি নির্মাণের জন্য বনভূমি অপচয় হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, শিল্প-কারখানা স্থাপন, সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি কারণে বনভূমি হ্রাস পাচ্ছে। তৃতীয়ত, অবৈধ বৃক্ষনিধন ও বনজ অপরাধের কারণে বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এছাড়াও, বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে অর্থ সংকট, জনবল ঘাটতি, সচেতনতার অভাব ইত্যাদি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বনবিভাগের নিয়ন্ত্রণে থাকা বনভূমির পাশাপাশি অনেক বনভূমি বেসরকারি মালিকানাধীন। এসব বনভূমি সংরক্ষণে বেসরকারি মালিকদের অনীহা বনভূমি সংরক্ষণে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
বনভূমি সংরক্ষণের উপায়সমূহ
বনভূমি সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম সফল করতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, অবৈধ বৃক্ষনিধন ও বনজ অপরাধ রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, বনায়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত, বনবিভাগের জনবল বৃদ্ধি করে বনাঞ্চল সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
এছাড়াও, বনায়ন কর্মসূচিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন করা যেতে পারে। বেসরকারি মালিকানাধীন বনভূমি সংরক্ষণে মালিকদের উৎসাহিত করতে হবে। শহরাঞ্চলে রাস্তার দুপাশে গাছ লাগানোর পাশাপাশি খালি জায়গাগুলোতেও বৃক্ষরোপণ করা যেতে পারে। সর্বোপরি, বনভূমি সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বনভূমি সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা
বনভূমি সংরক্ষণ শুধুমাত্র পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করেই না, এর অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রথমত, বনভূমি সংরক্ষণ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বৃক্ষরাজি কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে গ্রীনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করে। দ্বিতীয়ত, বনভূমি সংরক্ষণ জলচক্রকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে। তৃতীয়ত, বনভূমি সংরক্ষণ মৃত্তিকা অপরিক্ষয় রোধ করে এবং মৃত্তিকার উর্বরতা বজায় রাখে।
চতুর্থত, বনভূমি সংরক্ষণ বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল রক্ষা করে এবং জীববৈচিত্র্য সুরক্ষিত রাখে। পঞ্চমত, বনভূমি মানুষের স্বাস্থ্য ও কল্যাণের সাথে সরাসরি জড়িত। বনভূমি শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় সহায়তা করে। ষষ্ঠত, বনভূমি সংরক্ষণ ভূমিধস ও বন্যা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সপ্তমত, বনভূমি পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখে। অষ্টমত, বনভূমি থেকে বিভিন্ন ওষুধি উদ্ভিদ ও কাঠ সরবরাহ পাওয়া যায়। এভাবে বনভূমি সংরক্ষণের অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। তাই বনভূমি সংরক্ষণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url