জানাজার নামাজের নিয়ম ও দোয়া - জানাজার নামাজের নিয়ত

আসসালামু আলাইকুম bdvlog24 এর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম। আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হলঃ জানাজার নামাজের নিয়ম ও দোয়া - জানাজার নামাজের নিয়ত। লিখছি আমি আমির হামজা, তো চলুন আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শুরু করা যাক। 
জানাজার নামাজের নিয়ম ও দোয়া

জীবনের অনিবার্য সত্য হল মৃত্যু। প্রত্যেক প্রাণীকেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে একদিন। মৃত্যুর পর মানুষের দেহ কবরে বিশ্রাম গ্রহণ করে। কিন্তু মুসলিম বিশ্বাসে, আত্মাকে অনন্তকালের জন্য পরপারে উত্তীর্ণ হতে হয়। এই পরিক্রমায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হল জানাজা অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির জন্য বিশেষ নামাজ আদায় করা। ইসলামে এটি এক অপরিহার্য দায়িত্ব।

জানাজার নামাজ: মৃতদেহের সম্মানার্থে বিশেষ নামাজ

জানাজার নামাজ হল মৃত মুসলমানদের জন্য পড়া একটি বিশেষ নামাজ। এটি ইসলামের মৌলিক রীতিনীতির অংশ এবং মুসলিম সমাজের জন্য ফরজে কেফায়া বা আবশ্যিক দায়িত্ব। অর্থাৎ কোনো মুসলমানের মৃত্যুর পর তার জন্য জানাজার নামাজ আদায় করা সমগ্র মুসলিম সমাজের দায়িত্ব। যদিও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল বা গোষ্ঠীর লোকেরা এই নামাজ আদায় করলেই সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যায়।

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, "যে মুসলিম মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজে আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরীক করে নাই, এমন ৪০ জন লোক নামাজ আদায় করবে, তবে মৃত ব্যক্তির ব্যাপারে তাদের সুপারিশ আল্লাহ তায়ালা কবুল করবেন।" (মুসলিম)

জানাজার নামাজের নিয়ম ও নিয়ত

জানাজার নামাজ আদায়ের সময় কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। এটি একটি বিশেষ নামাজ হওয়ায় এর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমেই এই নামাজের জন্য নিয়ত করতে হয়। নিয়ত হল নামাজের উদ্দেশ্য বা মনোভাব। জানাজার নামাজের নিয়ত নিম্নরূপ:

"নাওয়াইতু আন উয়াদ্দিয়া লিল্লাহে তায়ালা আরবা আ তাকবীরাতে ছালাতিল জানাজাতে ফারজুল কেফায়াতে আচ্ছানাউ লিল্লাহি তায়ালা ওয়াচ্ছালাতু আলান্নাবীয়্যে ওয়াদ্দোয়াউ লেহাযাল মাইয়্যেতে এক্কতেদায়িতু বিহাযাল ইমাম মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতে আললাহু আকবার।"

বাংলায় এর অর্থ হল: "আমি চার তাকবিরের সহিত ফরজে কিফায়া জানাজার নামাজ কিবলামুখী হয়ে ইমামের পিছনে দাঁড়িয়ে মরহুম ব্যক্তির জন্য দোয়া করার উদ্দেশ্যে আদায় করছি। আল্লাহু আকবার।"

যদি আরবি নিয়ত করতে না পারেন, তাহলে বাংলায় নিয়ত করলেও চলবে। তবে নিয়তে "লেহাযাল মাইয়্যেতে" শব্দগুচ্ছ মৃতব্যক্তি পুরুষ হলে বলতে হবে, আর নারী হলে "লেহাযিহিল মাইয়্যেতে" বলতে হবে।

নামাজ শুরুর আগে করণীয়

জানাজার নামাজ শুরু করার আগে কিছু প্রস্তুতি নিতে হয়। প্রথমত, মৃতদেহকে কিবলামুখী করে রাখতে হবে। যদি মৃত ব্যক্তি পুরুষ হয়, তাহলে ইমাম তার মাথার পাশে দাঁড়াবেন। আর নারী হলে ইমাম মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়াবেন। এটাই মহানবী (সা.)-এর সুন্নত।

এরপর ইমামের নেতৃত্বে নামাজের জন্য দলবদ্ধভাবে সাজানো হবে। নামাজীরা বেজোড় সংখ্যক কাতার বা সারিতে দাঁড়াবে। ইমাম তাকবীর বলে নামাজ শুরু করবেন। তারপর সবাই হাত বেঁধে সানা পড়বে:

"সুবহানাকাল্লাহুম্মা ওয়াবিহামদিকা, ওয়াতাবারাকাসমুকা ওয়াতাআলা জাদ্দুকা, ওয়াজাল্লাছানাউকা ওয়ালা ইলাহা গাইরুকা।"

দরুদ শরীফ পাঠ

সানা পড়ার পর ইমাম তাকবীর বলবেন। তখন সবাই দরুদ শরীফ পড়বে:

"আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম্মাজীদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইব্রাহীমা ওয়া আলা আলি ইব্রাহীমা ইন্নাকা হামীদুম্মাজীদ।"

এরপর আবার ইমাম তাকবীর বলবেন। তখন নামাজীরা জানাজার দোয়া পড়বে।

জানাজার নামাজের দোয়া

জানাজার দোয়া নিম্নরূপ:

"আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যেনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গায়িবিনা ওয়া সাগীরিনা ওয়া কাবীরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনসানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামি ওয়া মান তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু আলাল ঈমানি বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমীন।"

অর্থাৎ, "হে আল্লাহ! আমাদের জীবিত ও মৃত, উপস্থিত ও অনুপস্থিত, ক্ষুদ্র ও বৃহৎ, পুরুষ ও নারীদের সবাইকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাকে ইসলামের ওপর বাঁচিয়ে রাখুন এবং যাকে মৃত্যুবরণ করিয়েছেন তাকে ঈমানের ওপর মৃত্যুবরণ করান, হে সর্বাপেক্ষা দয়ালু!"

তবে নাবালক ছেলে বা মেয়ের ক্ষেত্রে জানাজার দোয়া আলাদা। ছেলের জন্য দোয়া হবে:

"আল্লাহুম্মাজ আলহুলানা ফারতাঁও ওয়াজআলহুলানা আজরাঁও ওয়াযুখরাঁও ওয়াজআলহুলানা শাফিয়াঁও ওয়া মুশাফফায়ান।"

অর্থাৎ, "হে আল্লাহ! এই শিশুকে আমাদের জন্য পূর্বাহ্ন ও পরিচ্ছদ এবং পুণ্য ও সঞ্চয় বানাও এবং এই শিশুকে আমাদের জন্য সুপারিশকারী ও সুপারিশিত করো।"

আর মেয়ের জন্য দোয়া হবে:

"আল্লাহুম্মাজআলহালানা ফারতাঁও ওয়াজআলহালানা আজরাঁও ওয়াযুখরাঁও ওয়াজআলহালানা শাফিয়াতাঁও ওয়ামুশাফফায়াতান।"

অর্থাৎ, "হে আল্লাহ! এই শিশুকে আমাদের জন্য পূর্বাহ্ন ও পরিচ্ছদ এবং পুণ্য ও সঞ্চয় বানাও এবং এই শিশুকে আমাদের জন্য সুপারিশকারিণী ও সুপারিশিতা করো।"

জানাজার নামাজ সমাপ্তি

দোয়া শেষে ইমাম চতুর্থ তাকবীর বলবেন। তারপর সবাই একটু নীরব থাকবে এবং ডানে-বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে। যদি কেউ নামাজে দেরি করে আসেন, তাহলে ইমামকে অনুসরণ করবেন। সম্ভব হলে চারটি তাকবীর আদায় করবেন, নাহলে ইমামকে অনুসরণ করে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবেন।

জানাজার নামাজের ফজিলত ও গুরুত্ব

ইসলামে জানাজার নামাজকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এটি ফরজে কেফায়া হওয়ায় কিছু লোক যদি এই নামাজ আদায় করেন, তাহলে বাকি সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবেন। তবে সবাই যদি এড়িয়ে যান, তাহলে সমগ্র সমাজ পাপের ভাগীদার হবে।

একটি হাদিসে এসেছে, জানাজার নামাজে উহুদ পর্বতের সমান সওয়াব লাভ করা যায়। সুতরাং সুযোগ থাকলে এই নামাজ এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। এছাড়াও একজন প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন হিসেবে জানাজার নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য বিধায় নির্ধারিত।

নামাজের মাধ্যমে মৃতব্যক্তির জন্য দোয়া করা হয়, তাই এটি আদায় করলে মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি লাভ ঘটে বলে বিশ্বাস করা হয়। এছাড়াও জীবিতদের জন্যও এর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। জানাজার নামাজে অংশগ্রহণ করলে পরকালীন জীবনের জন্য আত্মিক শান্তি ও প্রস্তুতি লাভ করা যায়। একইসাথে মৃত্যুর প্রতি সচেতনতা বাড়ে এবং পরপারে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়।

জানাজার নামাজে অংশগ্রহণের নিয়মাবলী

জানাজার নামাজ একটি বিশেষ নামাজ হওয়ায় এটি আদায়ের সময় কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। প্রথমত, এই নামাজে অংশগ্রহণ করতে হলে ওযু করা বা গোসল করা আবশ্যক। যারা হায়েজ বা নিফাস অবস্থায় আছেন তারা এই নামাজ আদায় করতে পারবেন না। তবে উপস্থিত থাকতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, জানাজার নামাজের সময় নামাজীদের বেজোড় সংখ্যক সারিতে দাঁড়াতে হবে। তিন বা তারও বেশি সারি থাকতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে সামনের সারিটি সম্পূর্ণ পূর্ণ থাকতে হবে। তারপর যদি প্রয়োজন হয় তাহলে দ্বিতীয় সারিতে কিছু লোক দাঁড়াবে।

তৃতীয়ত, জানাজার নামাজ শুরু হওয়ার আগে সবাইকে নীরব থাকতে হবে। নামাজের সময় কথা বলা বা শব্দ করা যাবে না। এছাড়াও নামাজের সময় কোনো অতিরিক্ত আওয়াজ বা শব্দ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

চতুর্থত, নামাজের সময় মৃতদেহের দিকে মুখ করে দাঁড়াতে হবে। মৃতদেহের পায়ের দিকে দাঁড়ানো যাবে না। পুরুষদের জন্য মৃতদেহের মাথার দিকে এবং নারীদের জন্য মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়াতে হবে।

পঞ্চমত, জানাজার নামাজের সময় কোনো রকম আওয়াজ বা শব্দ করা যাবে না। এমনকি নামাজের পর মৃতদেহের কাছেও কোনো শব্দ করা উচিত নয়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নামাজ আদায় করতে হবে।

জানাজার নামাজের প্রক্রিয়া পর্যায়ক্রমে

এখন জানাজার নামাজের ধাপগুলো পর্যায়ক্রমে দেখা যাক:

১. প্রথমে ইমাম তাকবীরে তাহরীমা বলবেন এবং হাত তুলে নেবেন। অন্যরা তাঁর অনুসরণ করবে।

২. এরপর সবাই হাত বেঁধে সানা পড়বে।

৩. তারপর ইমাম তাকবীর বলবেন এবং সবাই দরুদ শরীফ পাঠ করবে।

৪. এরপর আবার ইমাম তাকবীর বলবেন এবং জানাজার দোয়া পড়া হবে।

৫. শেষ তাকবীরের পর সবাই একটু নীরব থাকবে এবং ডানে-বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবে।

যদি কেউ নামাজে দেরি করে আসেন তাহলে তিনি ইমামকে অনুসরণ করবেন। সম্ভব হলে চারটি তাকবীর আদায় করবেন, নাহলে ইমামকে অনুসরণ করে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করবেন। কারণ জানাজার নামাজ কাজা পড়ার সুযোগ নেই।

জানাজার নামাজ কখন আদায় করা যাবে না

কিছু বিশেষ অবস্থায় জানাজার নামাজ আদায় করা যাবে না। যেমন:

হায়েজ বা নিফাস অবস্থায় থাকলে নারীরা এই নামাজ আদায় করতে পারবেন না। তবে উপস্থিত থাকতে পারবেন।

মাদক বা অন্য কোনো নেশাগ্রস্থ দ্রব্য গ্রহণ করলে জানাজার নামাজ আদায় করা যাবে না।

বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যাগ্রস্থ ব্যক্তিদের এই নামাজ আদায় করার প্রয়োজন নেই।

শিশুদের জন্যও জানাজার নামাজ আদায় করার প্রয়োজন নেই। তবে তাদের জন্য বিশেষ দোয়া করা হবে।

কাফেরদের জন্য জানাজার নামাজ আদায় করা নিষিদ্ধ। কারণ তারা মুসলমান নন।

অন্যান্য সাধারণ অবস্থায় জানাজার নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য একটি অপরিহার্য দায়িত্ব বলে গণ্য করা হয়

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url