প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি সমূহ কি কি - মানুষ কিভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে?
আসসালামু আলাইকুম bdvlog24 এর পক্ষ থেকে আপনাদের সবাইকে স্বাগতম। আশা করি আপনারা সবাই ভালো আছেন। আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় হলঃ প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি সমূহ কি কি - মানুষ কিভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে? লিখছি আমি আমির হামজা, তো চলুন আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় শুরু করা যাক।
ভূমিকা
পৃথিবীর বুকে মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর সুষম সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি বিশাল বাস্তুতন্ত্র। এই বাস্তুতন্ত্রের প্রতিটি উপাদানের মধ্যে বিদ্যমান একটি নিখুঁত সামঞ্জস্য। যখনই এই সামঞ্জস্যের ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন সমগ্র প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর পড়ে ভয়াবহ প্রভাব। মানবজাতির অনিয়ন্ত্রিত ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী এই ভারসাম্যহীনতার জন্য। আসুন জেনে নেওয়া যাক প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার বিভিন্ন ঝুঁকি সম্পর্কে এবং মানুষ কীভাবে এই ঝুঁকিগুলো সৃষ্টি করছে।
প্রচণ্ড জ্বালানি ব্যবহার ও কার্বন নির্গমন
বর্তমান যুগে শিল্পায়ন ও যানবাহন চলাচলের জন্য অধিকাংশ দেশই নির্ভর করছে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর। জ্বালানি দাহ করার সময় উৎপন্ন হয় বিশাল পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস। এই গ্যাসটি গ্রিনহাউস ইফেক্ট সৃষ্টি করে এবং ফলে বৃদ্ধি পায় বৈশ্বিক উষ্ণতা। অতিরিক্ত উষ্ণতার কারণে গলে যায় হিমবাহ এবং বৃদ্ধি পায় সমুদ্রের জলস্তর। এছাড়াও জ্বালানি দাহের সময় নির্গত হয় বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিক যৌগ যা বায়ু ও মাটি দূষিত করে।
পাশাপাশি জ্বালানি দাহের ফলে উৎপন্ন হয় অধিক পরিমাণ তাপ। এই তাপ বায়ুমণ্ডলকে গরম করে তোলে এবং ফলে ঘটে বৃষ্টিপাতের হার কমে যাওয়া। এর প্রভাব পড়ে খাদ্য উৎপাদন ও জলাভূমির ওপর। সুতরাং জ্বালানি ব্যবহার সীমিত করা এবং বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন।
বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারের গুরুত্ব
- সৌর শক্তি
- বায়ু শক্তি
- জৈব জ্বালানি
- নিউক্লিয়ার জ্বালানি
এগুলো ব্যবহার করলে কম হবে কার্বন নির্গমন এবং তাপ উৎপাদন। ফলে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় থাকবে।
অতিরিক্ত শিল্পায়ন ও দূষণ নিঃসরণ
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রুত গতিতে বাড়ছে নতুন নতুন শিল্পকারখানা। এই শিল্পকারখানাগুলো থেকে নির্গত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ দূষিত বর্জ্য যা প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিষাক্ত করছে।
- কারখানার রাসায়নিক দ্রব্য নদী-নালায় ঢেলে দেওয়া হচ্ছে
- বায়ুমণ্ডলে ছড়ানো হচ্ছে বিষাক্ত গ্যাস
- অবৈধভাবে মাটিতে পুঁতে ফেলা হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্য
এসব কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বায়ু, জল ও মাটির গুণগত মান। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বিভিন্ন রোগবালাই এবং প্রাণঘাতী পরিস্থিতি।
দূষণ প্রতিরোধের উপায়
- শিল্প কারখানাগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে
- প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে দূষণমুক্ত শিল্প প্রক্রিয়া চালু করতে হবে
- জনগণকে সচেতন করে দূষণ প্রতিরোধের প্রচারণা চালাতে হবে
অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধি
বর্তমানে বিশ্বের জনসংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাড়ছে খাদ্য, বাসস্থান ও প্রাকৃতিক সম্পদের চাহিদা। এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে মানুষ প্রকৃতির ওপর অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করছে।
- কৃষি জমি বাড়ানোর জন্য বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে
- নতুন বসতি স্থাপনের জন্য নদীগর্ভ পুরণ করা হচ্ছে
- বেশি পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হচ্ছে
ফলে ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক আবাসস্থল এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব
- শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি
- পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন
- মানসম্মত জীবনযাপনের সুযোগ সৃষ্টি
- প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা
অতিরিক্ত প্লাস্টিক ব্যবহার
আধুনিক জীবনযাত্রায় আমরা প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহার করি। কিন্তু প্লাস্টিক একটি অ-বায়োভঙ্গনশীল উপাদান। এর অর্থ হলো প্রকৃতিতে এটি দ্রুত ভাবে বিনষ্ট হয় না। সুতরাং প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার পরিবেশের ওপর ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
- প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে নির্গত হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক যৌগ
- প্লাস্টিক কণা জমা হচ্ছে মাটিতে ও জলাশয়ে
- প্রাণীরা প্লাস্টিক গ্রহণ করে মারা যাচ্ছে
এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে হলে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ কমাতে হবে এবং বায়োভঙ্গনশীল উপাদানের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
প্লাস্টিক বিকল্প উপাদান
- কাঠ
- বাঁশ
- পাটকলা
- কাগজ
- প্রাকৃতিক রশমি
এসব উপাদান প্রকৃতিতে দ্রুত বিনষ্ট হয়। অতএব এগুলো ব্যবহার করলে পরিবেশের ওপর প্রভাব কম পড়বে।
জঙ্গল নির্মূলন ও বনভূমি হ্রাস
আধুনিক শিল্প-সভ্যতার বিস্তারের জন্য মানুষ প্রচুর পরিমাণে বনভূমি ধ্বংস করছে। গাছপালা কাটা হচ্ছে অসতর্কভাবে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য।
- গাছপালা কমে যাওয়ায় ঘটছে বায়ু দূষণ
- বনভূমি হ্রাসে প্রাণীদের আবাসস্থল হারাচ্ছে
- বৃক্ষরোপণের হার কমে যাওয়ায় ঘটছে মরুভূমিকরণ
বনভূমি রক্ষা করতে হলে নতুন নতুন গাছ লাগানোর পাশাপাশি বন অঞ্চলগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে হবে।
বনায়নের গুরুত্ব
- বায়ু শুদ্ধিকরণ
- মৃত্তিকা অপরিধন প্রতিরোধ
- বৃষ্টিপাতের হার বৃদ্ধি
- জৈববৈচিত্র্য রক্ষা
কার্বন সিংক করে গ্রিনহাউস প্রভাব হ্রাস
সুতরাং বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন।
জলাভূমি ও নদীগর্ভ দখল
শহরায়ণ ও বসতি স্থাপনের জন্য মানুষ নদীগর্ভ ও জলাভূমি দখল করছে। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর পড়ছে গুরুতর প্রভাব।
- নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ বিচ্যুত হচ্ছে
- জলাভূমির পানি নিকাশ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে
- বন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা দেখা দিচ্ছে
এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাক হচ্ছে প্রাকৃতিক জলচক্র। জলাবদ্ধতার কারণে বাড়ছে বিভিন্ন রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব। অপরদিকে নদীগর্ভ দখলের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নদীর প্রাণীকুল। এসব সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে জলাভূমি ও নদীগর্ভ সুরক্ষিত রাখতে হবে অবশ্যই।
জলাভূমি সুরক্ষার উপায়
- নদী-খাল ও হ্রদের তীরবর্তী এলাকা রক্ষা করা
- জলাভূমিতে অবৈধ নির্মাণ কাজ বন্ধ করা
- জলাভূমির মধ্যে দিয়ে রাস্তাঘাট নির্মাণ না করা
- জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য পানি নিকাশ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন
অপরিকল্পিত শহরায়ন ও বসতি স্থাপন
দ্রুত শহরায়নের ফলে শহরাঞ্চলগুলোতে বাড়ছে জনঘনত্ব। এর সাথে তাল মিলিয়ে না থাকায় শহরগুলোর আবাসিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটছে না। ফলে দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন সমস্যা।
- বাড়ছে যানবাহন চলাচল এবং দূষণের মাত্রা
- ঘটছে আবর্জনা ব্যবস্থাপনার সমস্যা
- পরিকল্পনাহীন নির্মাণকাজের কারণে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ
এসব সমস্যা সমাধানের জন্য শহর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন অপরিহার্য। শহরগুলোকে করতে হবে পরিবেশবান্ধব এবং জনবান্ধব।
পরিবেশবান্ধব শহর গড়ার উপায়
- শহরে প্রচুর বৃক্ষরোপণ ও উদ্যান নির্মাণ
- সবুজ অঙ্গন ও খেলার মাঠ রাখা
- যানবাহন চলাচলের নিয়ন্ত্রণ ও পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন
- আবর্জনা ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি আধুনিকায়ন
- প্রাকৃতিক পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা
অপরিণামদর্শী কৃষিপদ্ধতি অবলম্বন
খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে মানুষ অনেক সময় অপরিণামদর্শী কৃষিপদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। এর ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর পড়ে বিরূপ প্রভাব।
- রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের মাত্রা বেড়েছে অসীম পরিমাণে
- জৈব সার ব্যবহারের হার অপর্যাপ্ত
- ফসল চক্রের পরিবর্তন ঘটছে না যথাযথভাবে
জৈব কৃষিপদ্ধতির সুবিধা
- মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়
- কীটপতঙ্গের প্রাকৃতিক শত্রু সংরক্ষিত হয়
- খাদ্যে রাসায়নিক অবশেষ থাকে না
- পরিবেশের ওপর প্রভাব কম পড়ে
- স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত হয়
অপচয় ব্যবস্থাপনার অভাব
- অধিকাংশ বর্জ্যই নদীনালায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে
- কিছু কিছু বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিতভাবে
- শহরাঞ্চলগুলোতে লন্ডভন্ড অবস্থায় পড়ে থাকছে বর্জ্য
আবর্জনা ব্যবস্থাপনার উপায়
- বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিং প্রক্রিয়া চালু করা
- বায়োডিগ্রেডেবল বর্জ্য থেকে কম্পোস্ট সার তৈরি করা
- শহরগুলোতে ডোর-টু-ডোর বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থা করা
- বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন
বিলাসিতা ও অপচয়মুখী জীবনযাত্রা
আধুনিক সভ্যতার প্রভাবে মানুষের জীবনধারা দিন দিন বিলাসিতামুখী হয়ে উঠছে। অথচ এই বিলাসিতা পূরণের জন্য প্রয়োজন হচ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয়। ফলে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য।
- বেড়েছে অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ব্যবহার
- বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির অপচয়
- বৃদ্ধি পাচ্ছে অপচয়জনিত বর্জ্যের পরিমাণ
এই সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে জীবনযাত্রার ধরন পরিবর্তন করা। সচেতনতা বৃদ্ধি করে সরল জীবনযাপনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া প্রয়োজন।
সচেতন জীবনযাত্রার উপকরণ
- অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবহার পরিহার করা
- জ্বালানি ও বিদ্যুতের অপচয় রোধ করা
- পুনর্ব্যবহার ও রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে অপচয় কমানো
- প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা
এভাবে সচেতন জীবনধারা গ্রহণ করলে নিশ্চিত হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের সুরক্ষা।
মানুষের অবহেলা ও অসচেতনতার কারণেই বর্তমানে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে দ্রুত গতিতে। যদি এখন থেকে না সচেতন হওয়া যায়, তাহলে অদূর ভবিষ্যতেই পৃথিবী হয়ে উঠবে বসবাসের অনুপযোগী। সুতরাং আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে এবং প্রকৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। শুধুমাত্র তাহলেই আমরা রক্ষা করতে পারব প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url